চার.
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে,কর্পোরেটবাদীদের চোখ পড়েছে এশিয়ার কৃষিবাজারের দিকে। আর খাদ্যবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়ার অন্যতম কারণ এটাই। তারা চান কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের বাজারকে নতুনভাবে বিন্যাস করতে। চান কৃষিপণ্যের বাজারকে কর্পোরেটবাদীদের উপযোগী করে তুলতে।
তবে কোনও কোনও দেশকে তো গিনিপিগ হতে হবে। বাংলাদেশ হলো সেই গিনিপিগ,কর্পোরেটবাদীদের কর্পোরেটতন্ত্র পরীক্ষানিরীক্ষার এশিয় গবেষণাগার। কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক শাসন প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি,সংগঠিত বামআন্দোলন গড়ে না উঠলেও বুর্জোয়া রাজনীতি প্রতিনিয়ত অস্থিতিশীল আর পুঁজিবাজারও সুগঠিত নয়। তা ছাড়া এখানে গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহও বিকশিত হয়নি যথাযথভাবে। বাজারব্যবস্থাও খুবই দুর্বল। অথচ অন্যদিকে বাংলাদেশের মাটি এতই উর্বর আর কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই এখানকার কৃষি উৎপাদন এত সন্তোষজনক যে এরকম সোনার খনি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার মতো বোকামী আর হতে পারে না। আর চীন ও ভারতের জনবহুল বাজারের দিকে তাকিয়ে লোভাতুর হওয়া যায়,কিন্তু তাদের তো গিনিপিগ বানানো সম্ভব নয়।
অবশ্য,এশিয়ায় না হলেও,বিশ্বব্যাপী কৃষিবাণিজ্য অনেক আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে কর্পোরেটবাদীরা। ১০টি মুখচেনা বহুজাতিক কোম্পানী নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বের চালগমসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনের বীজবাজারের ৫১ শতাংশ। এ ১০টি কোম্পানীর সমগ্র ব্যবসার ৭০ শতাংশ আবার নিয়ন্ত্রণ করছে তাদেরই চারটি কোম্পানী। এদের নাম মোটামুটি সবারই জানা। এরা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের মনসানতো ও দুপন্ট,সুইজারল্যান্ডের সিনজেনটা এবং ফ্রান্সের গ্রুপে লিমাগারিন। অনেকেই জানেন,বাংলাদেশের মহান নোবেল শান্তিবাজ ড. মুহম্মদ ইউনূসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মনসানতো কোম্পানির সঙ্গে।
পৃথিবীজুড়ে খাদ্যসামগ্রীর খুচরা বাজারের এক-চতুর্থাংশ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে শীর্ষ ১০টি খাদ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান। এই ১০টি কোম্পানীর সমগ্র বাজারের ৬৫ শতাংশ রয়েছে আবার আমেরিকার ওয়ালমার্ট,ফ্রান্সের কোরেফুর,জার্মানীর মেট্রো এজি এবং নেদারল্যান্ডসের আহোলন্ড-এর নিয়ন্ত্রণে।
উন্নত দেশগুলি কৃষিভর্তুকি দিয়ে তাদের কৃষিখাতকে শক্তিশালী করে রেখেছে। আবার কৃষিপণ্যের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এসব দেশেরই হাতেগোণা বাণিজ্যিক কোম্পানীগুলো। এসব বাণিজ্যিক বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণেই উন্নয়নশীল ও ¯^‡ívbœZ আয়ের দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় তুঙ্গে উঠেছে। কেননা এসব বহুজাতিক বাণিজ্যিক কোম্পানীগুলোই মূলত কৃষিবাণিজ্যে বৈষম্যমূলক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিধির সুবিধা নিচ্ছে। আর উন্নত দেশগুলোর কৃষিভর্তুকির সুবিধাগুলোও সেখানকার কৃষকদের বদলে মূলত লুটে নিচ্ছে এসব কোম্পানীগুলো।
এই কোম্পানিগুলো এখন চাইছে বিশ্বের যেসব দেশের কৃষিবাজার তাদের তত্ত্বউপযোগী নয়,সেসব দেশের কৃষিবাজারকে তেমনটি করে তোলার।
এপ্রিল ২০০৮-এর মধ্যেই এ বিষয়টি কারও কারও চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একে একে ভয়ংকর সব খবর আসতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে ২৬ এপ্রিল ২০০৮-এ খবর বের হলো,চাল,গম,আটাসহ খাদ্যশস্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। আর এর ফলে বাংলাদেশ,ক্যামেরুন,ফিলিপাইনসহ বেশকিছু দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কেননা সেখানে দেখা দিচ্ছে সহিংসতা। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট বি যোয়েলিক বললেন,খাদ্যসংকটের কারণে বিশ্বের আরও ৩০টি দেশে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। আর হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারা বললেন বিশেষভাবে বাংলাদেশের কথা। বললেন,বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলির মানুষের খাবার কেনার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। এইভাবে বাংলাদেশ আলোচনার পাদপ্রদীপে চলে এলো।
যদিও ম্যানিলাভিত্তিক গবেষণাসংস্থা ইরির পক্ষ থেকে বলা হলো,এই সংকট মানবসৃষ্ট,কিন্তু কেউই সে কথা গায়ে মাখলেন না। বলা হতে লাগল,জৈবজ্বালানি উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় এই সংকট সৃষ্টি দেখা দিয়েছে। বলা হতে লাগল,এই সংকটের কারণ ভারত ও চীনের খাদ্যবাজার বেড়ে গেছে।
কিন্তু শক থেরাপী বাজারকৌশলের প্রধান শর্তই হলো,লোহা গরম থাকতে থাকতেই ছ্যাঁকা দিতে হবে। অতএব খুব দ্রুতই সুগঠিত প্রস্তাব এলো ২০০৬ সালে মিল্টন ফ্রিডম্যানের মৃত্যুর পর মুক্ত বাজারের নব্য পথিকৃৎ মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফ্রী সাশের পক্ষ থেকে। তিনি বললেন,জরুরি সাহায্য দেয়ার কোনও মানে নেই। এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী সহায়তার। এ রকম একটি প্রস্তাব যে আসবে সেটি অবশ্য অনুমান করা যাচ্ছিলো। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল,খাদ্যসংকটগ্রস্থ আফ্রিকার দেশগুলিকে তারা সহায়তা করবেন,তবে আগের মতো করে নয়। এবার আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেদের জাহাজে করে খাদ্যসাহায্য পাঠাবেন না তারা। বরং আফ্রিকার যেসব দেশ খাদ্য উৎপাদন করে,সেসব দেশ যদি খাদ্য বিক্রি করে তা হলে সেই খাদ্য কেনার টাকা দিয়ে সহায়তা করবেন মাত্র।
আপাতদৃষ্টিতে জেফ্রী সাশের কথাবার্তা ও নীতিপ্রণালী খুবই নিরীহ। কিন্তু আসলে তা তত নিরীহ নয়। কেননা কাঠামোগত সহায়তা দেবে কর্পোরেটবাদীরা;আর তাদের কাছে চিরদিনের মতো বাঁধা পড়ে যাবে আমাদের মতো দেশগুলোর স্থানীয় কৃষি বাজার। এ পরামর্শের আরেকটি লক্ষ্য,জৈবজ্বালানীর উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া। উল্লেখ্য,ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত বসন্তে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে,আগামী ২০২০ সালের মধ্যে তারা পরিবহন ক্ষেত্রে জৈবজ্বালানির পরিমাণ ১০ শতাংশে উন্নীত করবে,যা আগামী ২০১০ সালের মধ্যে ৫.৭৫ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা আরও আগেই নেয়া হয়েছিল। জেফ্রী সাশ-রা এই পরিকল্পনাকে একদম সহ্য করতে পারছেন না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্নয়ন কমিটির সামনে জেফ্রী সাশ বলেছেন,পৃথিবীব্যাপী খাদ্যমূল্যের ক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা খাদ্য সরবরাহের রুদ্ধপ্রক্রিয়ার কারণে ঘটছে না;এ-অবস্থার জন্ম হয়েছে খাদ্যের ক্রমবর্ধিষ্ণু চাহিদা থেকে। পৃথিবীতে খাদ্যের এই সরবরাহ ও চাহিদাসংকটের কারণ,সাশ-এর মতে,দরিদ্র অঞ্চলগুলিতে খাদ্যউৎপাদনÔযা হওয়া উচিত তার চেয়ে অনেক কম।Õঅতএব এইসব দেশে এমন কাঠামোগত সহায়তা দিতে হবে,যাতে তারা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারে।
সাশ এখানেই থামেননি। তিনি তাঁর সাফল্যের উদাহরণও তুলে ধরেছেন। বলেছেন,পৃথিবীর একটি গরিব রাষ্ট্র মালোয়িতে এ ধরনের কাঠামোগত সহায়তা দেয়া হয়েছে এবং গত তিন বছর ধরে সেখানে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ হচ্ছে। তিনি বলেছেন,প্রকৃতির মতিগতি বোঝা বড় দায় হয়ে পড়েছে। অতএব অর্থায়ন করতে হবে মূলত এমন ধরণের বীজ উদ্ভাবনী গবেষণার ক্ষেত্রে,যে ধরনের বীজ খরা ও আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। অর্থাৎ কাঠামোগত সহায়তার নামে যা-যা করা হবে তার সব সুফলই ভোগ করবে কর্পোরেট সংস্থাগুলো।
আর মালোয়ির অবস্থা?আপাতত শুধু এটুকুই বলা যায়,মালোয়িতে শস্য উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই,কিন্তু তার মানে এই নয় যে দরিদ্র কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে!